ফাতরা জঙ্গল ও আমার ছেলেবেলা (পর্ব-২)

ছোটবেলা থেকেই একটু দুষ্টমি বেশি করতাম। আমার সহপার্টি দুই জন, একজন আমার চাচাতো ভাই আবদুল কুদ্দুস ও তার বৈমাত্রিক ভাই ইউনুছ, নাম দুইটা বেশ সুন্দর। তারা সবসময় আমার কাছে কাছে থাকতো, নদীতে যখন জোয়ার আসতো নদী কানায় কানায় পরিপূর্ন হয়ে যেত, জেন সে এক বিষ্ময় আনন্দ। আমরা তিন জন প্রায় সময়ই ছইলা, কেওড়া গাছ থেকে লাফ দিয়া জোয়ারের পানিতে পড়তাম, এটা এক ধরনের আনন্দও বটে। কিন্তু এর পিছনে অনেক বড় বিপদ থাকতে পারে তা আমাদের কারোই জানা ছিল না।

বড় বড় মাছ জোয়ারের পানিতে চলে আসতো, সব চাইতে বেশী ভীতির কারন ছিল যেটা, সেটা হলো কুমির ও হাংগর মাছ, যাহা মানুসের জন্য প্রধান ভীতির কারন, কিন্তু এর ক্ষতির পরিমান টা আমাদের জানা ছিল না। আমরা যখন সুজোগ পাইতাম আর কথা নেই সাথিদের পাইলেই নদীতে সাতার কাটতাম এবং গাছ থেকে ঝাপ দিতাম। এক দিন আমরা তিন জন একই নিয়মে কেওড়া গাছ, সে অনেক উচ্চ চল্লিশ পঞ্চাশ হাতের বেশী হবে বৈকি। আমরা একত্রে তিনজন গাছে উঠলাম এবং লাফ দিয়া ঝপাত করে নদীতে লাফিয়ে পড়লাম। সে কি আনন্দ ... সাতরে আবার কিনারে, আবার গাছে উঠলাম।এমনি করে, বারবার পালা করে লাফা লাফি করছিলাম। এমন সময় দেখা গেল আমাদের চারটা পাতিহাস নদীতে সাতার কাটতেছিল, ভালই লাগতে ছিল, আমার কাছে হাস গুলোকে মনে হলো যেন এক ধরনের নৌকার মত। জোয়ারের পানিতে সাতার কাটা, সে এক আনন্দ না দেখলে ভাল বোঝার উপায় নাই।

হঠাৎ হাসগুলো আনেক জোরে চিৎকার শব্দ করলো পক পক করে উঠলো, আমরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি । আমরা এক এক করে গাছে উঠার চেষ্টায় রত এমন সময় দেখা গেল তিনটি হাস উড়ার চেষ্টায় সাতার কাঠতেছে, আর একটি হাস নাই । আমরা হাসটি চোখের দৃষ্টিতে খোজতে আরম্ভ করলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। আমি কুদ্দুসকে বললাম "ভাই আমাদের হাসাটা কৈই, পানিতে ডুব দিল? উঠে না কেন? এমন সময় আমার বড় ভাই নদীর দিকে আসলো, আইসা বলতে লাগলো, হাসাটাকে কি কুমিরে নিয়া গেল? আমাদের সবাইকে গাছে দেখে ডাক দিল তোরা ওহানে কি কর? গাছে উঠছ কেন? এ নদীতে লাফ দিস না যেন, খালে কুমইর আছে। রাখ, দেইখা লই, হাসটা গেল কৈই।

আমার ভাই কিছু সময় এদিক ওদিক তাকাইয়া বলতাছে । "এ তোরা দেখতো মোগো হাসটা দ্যাহ কিনা"। আমরা সবা্ই উপর থেকে দেখলাম একটি ছইলা গাছের মত ১২/১৪ হাস লম্ভা একটা কি যেন ভাসে আছে সেটার মাথায় হাসের পাখা ভাসতেছে। আমি বললাম নেয়াভাই, ঐতো ছইলা গাছের ঘোরায় হাসের পাখ ভাসতেছে। ভাইয়া আর একটু আগাইয়া দেখতে ছিল, দেখে আব্বাকে ডাকদিল, বাবা আমাগো হাসাটা কুমইরে নিছে। কুমইর কথাটা কেমন যেন খারাপ লাগলো, একটু লাফা লাফি করবো জোয়ারের পানিতে, আমার ভাই আমাকে সাবধান করলো আর লাফ দিস না। নিচেও নামিস না। তোরা গাছে থাক। আমি আব্বারে বোলাই। আব্বা কথা শুনে ট্যাডা হাতে আসলেন, তিনি এসে অভাক দৃষ্টিতে তাকাইয়া দেখার পর বললো, অনেক বড় কুমির মারা সম্ভব না। কিছুক্ষন পর কুমিরটা ডুব দিল। আমরা ভয়ে ভয়ে গাছ থেকে নেমে আসলাম। আমার কাছে মনে হলো এটি একটি বাকা গাছ, অসমান গাছ। যদিও আমার ভাই এবং বাবা আমাকে অনেক ভয় ডর দেখাইয়া ঐদিনে মত লাফা-লাফিটা বন্ধ করে দিয়ে ছিল। কিন্তু আমি এবং আমার সংগী ও সাথীরা সুয়োগ পাইলেই এমনি ভাবে গাছ থেকে লাফ দিতাম এটা ছিল আমাদের এক ধরনের ধারা বাহিক আনন্দও বটে। অনেক দিন পর তালুকদার বাড়ীর পাশ্বের খালে জালে একটি কুমির ধরা পড়লো আমি এবং আমার সাখিরা সেটাকে দেখতে গেলাম । আজ আমার ভয় শরীর কাটা দিয়া উঠতে লাগলো। আমি এর পর বুঝতে শিক্ষলাম যে কুমিরের ভয়াবহতা কতটা হতে পারে। তার লেজের কাটা গুলো, কতবড়ই না তার লেজ, এই লেজ দিয়া নৌকা থেকে কত মানুষকে ফেল দিয়াছে, কত জেলে কুমিরে খেয়েছে তার কোন হিসাব জানা না্ই। ছোট ছোট গল্প শুনতাম কিন্তু আজ সেই গল্প আমার চোখে দেখে নিজেকে অনেক সাবধান করে দিলাম। আমার ছেলে বেলার একটা চরম অভিজ্ঞতাও বটে। তখন না বুঝে যে কত বড় বড় ভুল করেছি, আজ তা মনে হলে আমার শরীর শিউরে ঊঠে। আমার সন্তানরা শুনলে হয়তো গল্পই মনে করবে,আর নাতি নাতনিরা তো কথাই না্ই। আমরা সোনার বাংলার দক্ষিন সীমান্তে যারা বসবাস করি তাদের জীবন জিবিকা যে কেমন তা না দেখলে হয়তো বুঝা যাবে না। আর আমার বয়সের কেউ বেচে না থাকলে তো আর কথাই নাই। যাই হোক...........

আমার একটু একটু করে বযস বাড়তে আরম্ভ করলো এবং ভয় কথাটা একটু একটু করে মাথায় ডুকতে আরম্ভ করলো।

আমি আজ সেই নদীর পাড়ে এসে দাড়াই কিন্তু কোন কুমির দেখতে পাইনি। কিন্তু দেখতে পাই এক ধরনের ভয়াবহতা, যা আমার মনকে সব সময় আচ্ছাদিত করে রাখে সে হলো মানুষের হিংস্র থাবা যা সেই কুমির গুলোকেও হার মানায়্ । সেই নদী আছে, আমি আছি, নেই আমার সাথিরা, সেই কুমির নেই, নে্ই সেই আনন্দঘন পরিবেশ। নেই সেই পিঠা পায়েস। নেই গোলগাছ, নেই গোলের রস, গোলের মিঠা। গোলগাছের ছাইনি ঘর, কালের অতল ঘহব্বরে তলিয়ে গেছে সব কিছু। যেই নদীগুলো ছিল কুমিরের দখলে আর আজ সেই নদীগুলো মানুষের দখলে। চলছে সেখানে অনাচার আর অবিচার চলছে নদী শাসন, চলছে নদী দুর্ষন ইত্যাদি।

সেকালে কুমির গুলো যত নির্মম ছিল কিন্তু তার চাইতেও বেশী নির্মম বর্তমান সমাজের মানুষ গুলো, আমি সে সময়ের কুমির গুলোকে যতটা না ভয় পাইতাম তার চাইতে বেশী ভয় পাইতেছি আমার বর্তমান সমাজের মানুষগুলোকে। আমি যদি আবার ফিরে যেতে পারতাম, আমার সেই ছেলেবেলায়, কতনা ভালই হতো, এবং কতনা আনন্দই হতো।

আমার কথা শুনে আপনাদেরও হয়তো বা ছেলেবেলার কথা গুলো স্মরন করিয়ে দিলাম, এতে হয়তো কেউ কেউ আনন্দ পাবেন আবার কেউ কেউ কষ্টও পেতে পারেন, আমি কারো কষ্টর কারন হতে চাই না্ ।

আমার সাতার কাটা পায়রা নদী, আমার খুবই প্রিয় নদী। এই নদীর ইলিশ মাছ যদি কেউ খেয়ে থাকেন তবে তার অবশ্যই ভাল লাগবে। আমার জীবন টা এখানেই মিশে আছে, তাই ভাল বাসি আমার মাকে, ভালবাসি এই আমার মাতৃভূমিকে। সবশেষে "এই তো আমার জন্মভুমি"। যতই দুঃখ কষ্ট, আনন্দ, বেদনা থাকুক না কেন, আমি বারবার ফিরে আসি আমার মায়ের কোলে, জন্মভূমির ছায়া তলে। কারন এখানেই আমার নাড়ি পোত আছে।

Comments

Popular posts from this blog

গোলের রস ও গোলের মিঠা

কাউফল-দেশীয় ফল

"ঢেউয়া" একটি গ্রাম্য অপরিচিত ফল