গোলের রস ও গোলের মিঠা
আমার বয়স যখন ৭/৮ বৎসর তখকার কথা, নদীর কাছে, গোলগাছের ডিকা কেটে এক ধরনের
নৌকা বানাতে চেষ্টা করতাম ও ভাষাতাম, এটা তৈরি করতে ব্যবহার করতাম খেজুরের
কাটা ও লতা পাতা। এটা ছিল এক ধরনের খেলনা। সাথে আমার চাচাতো ভাই ও ফুফাতো
ভাই ছিল খেলার সাথি। খুব ছোট্ট বেলা থেকেই আমরা এই গোলপাতা বা গোল গাছের
সাথে পরিচিত ছিলাম, বা আছি, কারন আমার বাড়ি আমতলী ও তালতলীর মধ্যেখানে। তখন
এই গোলপাতা দিয়ে আমাদের গরুঘর ও পাকের ঘর তৈরি ছিল, বাকি ঘর ছিল, টিনের
ছাউনি, আমি জন্ম হয়েই টিনের ঘরে বসবাস করে আসছি। আমাদের গ্রামের ৮০% বাড়ী
ঘরই গোলপাতার ছিল। বর্তমানে এই গোলপাতার দেখা মেলা মোটামুটি ভার। সবার
ঘরগুলোই টিনের ও কিছু ইমারত।
গোলপাতা, শুনলেই মনে হয পাতাটা গোল আসলে এর পাতা গোল নয়, কিন্তু তারপরেও তার নাম গোলপাতা। এটি মূলত পাম জাতীয় বৃক্ষ। বৈজ্ঞানিক নাম Nypa fruticans।
এই গাছগুলো নদীর পার জুড়েই জন্মে তবে জোয়ার ভাটা থাকতে হবে এবং লবনা্ক্ত পানিতেই তার বেশী দেখায়। গোলপাতার গাছ বাংলাদেশের সুন্দরবন ছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দেশের সমুদ্রতীরবর্তী অংশে জন্মে। বাংলাদেশ ছাড়া ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ভিয়েৎনাম, শ্রীলঙ্কায় জম্মাতে দেখা যায়।
এর পাতা নারিকেল পাতার মত এক প্রকার লম্বা পাতা বিশিষ্ট গাছ বিশেষ। পাম গোত্রের তালগাছ সদৃশ এই গাছ আকৃতিতে ছোট। এর কাণ্ড মাটির নিচে অনুভূমিক বিস্তার লাভ করে। শুধু এর পাতা এবং ফুল মাটির উপরে দৃশ্যমান হয়। এর ডাঁটাসহ পাতার ফলক দৈর্ঘ্য ৮ থেকে ১০ ফুট হয়ে থাকে।
এর লাল রঙের স্ত্রীফুল উপরের দিকে ফোটে। পক্ষান্তরে হলুদ পুরুষ ফুলগুলো অপেক্ষাকৃত নিচুতে ফোটে। এর ফল জাম্বুরা মত বড়। ঘর ছাওয়া ও ঠোঙা বানানোর জন্য গোলপাতা ব্যবহার করা হয়। গোলপাতার ফল অনেকটা তাল শাঁশের মত।
এই গাছের পাতা ঘরের চাল ছাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
ভোলার চরাঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র পরিবারের কাছে এখনো জনপ্রিয় বনের গোলপাতা। অল্প টাকায় তৈরি হয় গোলপাতার ঘর। ফলে তারা গোলপাতায় তৈরি ঘর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত ইউনিয়নের নাম চর কুকরী-মুকরী। এখানে রয়েছে বন বিভাগের ৮ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল। নান্দনিক এসব বনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খালের দুই পাড়ে ও ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে নারিকেল গাছের পাতার মতোই ছোট ছোট গোলপাতা গাছ। বন বিভাগের আওতায় চরাঞ্চলে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য এসব গাছ রোপণ করা হয়ে থাকে। বন প্রহরীরা এসব গাছের পরিচর্যা করেন। নিজস্ব নার্সারিতে গোলপাতা গাছের বীজ রোপণের পর পরিচর্যার এক পর্যায় ৯ থেকে ১০ ইঞ্চি হলে সেগুলো নিয়ে খালের পাড়ে এবং বনের ভেতরে রোপণ করা হয়।
অপরদিকে তাদের নিজেদের থাকার ভালো ঘর না থাকলেও বন বিভাগ গোলপাতার বাগানের পরিচর্চা করে । চরাঞ্চলের অধিকাংশ লোকই হতদরিদ্র অল্প টাকায় ঘর নির্মাণের জন্য সহযোগিতা করাই বন বিভাগের আসল উদ্যেশ। একই সাথে এ কাজে তাদের আনন্দ লাগছে। বন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বনের পাশেই হতদরিদ্র পরিবারগুলোর বসবাস। কৃষিকাজ আর নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করাই এসব পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কাজ। তাই টিনের ঘর করা তাদের পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় গোলপাতাই তাদের প্রধান ভরসা। ২৫ হাজার টাকা ব্যয়ে একবার ঘর নির্মাণ করলে ৫ বছর কেটে যায়। তাছাড়া এই ঘর গুলো বসবাসের জন্য বেশ আরামদায়ক হয়। গরমের সময় বেশী গরম হয় না। এবং শীতের সময়ও বেশী শীত লাগে না।
আপনী যদি তাদের কাছে জানতে চান যে, গোলপাতার ব্যবহার সম্পর্কে তারা বলবে, একবার গোলপাতা দিয়ে ঘর নির্মাণ করলে তাদের ৫ থেকে ৭ বছর কেটে যায়। এছাড়া নাড়া (ধানের নিচের অংশ) দিয়ে ঘর করলে প্রতিবছর সংস্কার করতে হয়। আর তাদের পক্ষে টিনের ঘর তৈরি করা সম্ভব হয় না বলে গোলপাতাই হচ্ছে তাদের একমাত্র ভরসা। নাড়া দিয়ে ঘর তৈরি করলে এক বছর স্থায়ী হয় আর গোলপাতা দিয়ে করলে ৫ থেকে ৭ বছর স্থায়ী হয় বলে গরিব মানুষেরা গোলপাতার ঘর তৈরি করেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সরকার নির্ধারিত রেভিনিউয়ের মাধ্যমে গোল গাছের এসব পাতা বিক্রি করা হয়ে থাকে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ঘুটাবাছা গ্রামের গোলগাছের রস সংগ্রহের জন্য ডগা ধারালো দা দিয়ে সূক্ষ্মভাবে কাটা হচ্ছে।
নোনাজলে জন্ম, নোনা সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অথচ এর ডগা (ডাণ্ডি) থেকে বেরিয়ে আসছে মিষ্টি রস। সেই রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড় (মিঠা)। সুস্বাদু এই গুড়ের চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। মুখে নিলেই অভিজ্ঞরা বুঝতে পারেন এর স্বাদের ভিন্নতা। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি পরিবার কয়েক বছর ধরে এই গুড় তৈরি করছে। এখানে গোলপাতার চাষও করা হয়।
কলাপাড়া-কুয়াকাটা সড়কটি নীলগঞ্জ ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বরাবর চলে গেছে বঙ্গোপসাগরের সৈকতের দিকে। সড়কটি ধরে দক্ষিণে চলতেই রাস্তার ধারে একাধিক স্থানে চোখে পড়ে গোলপাতা গাছের বহর (বাগান)। এমন একটি বহর থেকে রস সংগ্রহ করছেন নীলগঞ্জের ঘুটাবাছা গ্রামের চাষিরা। সকাল-বিকেল দুই বেলা চলে তাঁর গোলপাতা গাছের ডগা কাটার কাজ। দুবেলাই রস পাওয়া যায, এবং তাপাল বা পাতিলে জ্বালাইয়া মিঠা তৈরি করা হয়, এর মিঠা বেশ সুস্বাদু, এগুলো কলাপাড়া বাজারে ৭০/৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। মুখে তুলতেই বুঝা যাবে এটা গোলের মিঠাই, এর পিঠা ও পায়েশের স্বাদই আলাদা, বেশীর ভাগ মিঠাতেই রওয়া পরে যায়, মিশ্রির দানার মত যে একবার খেয়েছেন, নিশ্চই তিনি বার বার খেতে চাইবেন।
সাধারনত আষাঢ় মাসে গোল গাছের ডাণ্ডিতে গাবনা ফল হয়। পৌষ মাসে ফলসহ মাটিচাপা দিয়ে ডাণ্ডি নুয়ে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসে ডাণ্ডিটি মানুষের পায়ের আলতো লাথি দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে রসে ভার করার জন্য দোয়ানো হয়। ১৫ দিন এভাবে দোয়ানোয় পর গাবনা ছড়ার আগাছা পরিষ্কার করে ডগার মাথা থেকে গাবনা ফলের থোকা ধারালো দা দিয়ে এক কোপে কেটে ফেলা হয়। এরপর ডাণ্ডির কাটা অংশ তিন দিন শুকিয়ে নেওয়ার পর সকাল-বিকেল দুইবেলা পাতলা করে (একসুত পরিমাণ) কেটে ফেলা হয়। এভাবে চলে আরো ১৫ দিন। এরপর প্রতিদিন বিকেলে একবেলা ডাণ্ডার মাথা দিয়ে কিঞ্চিত অংশ কেটে রশির সঙ্গে একটি ছোট্ট হাঁড়ি বেঁধে রাখা হয়। পরদিন খুব ভোরে রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতি বছর পৌষ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে রস সংগ্রহ করা। প্রতিটি ডাণ্ডি থেকে ২৫০-৫০০ গ্রাম পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। কমপক্ষে এক একর জমির বাগানের ১৫০টি ডাণ্ডি থেকে প্রতিদিন রস সংগ্রহ হয় ৪/৫ কলসি। প্রতি কলসিতে রস ধারণক্ষমতা ২৫ থেকে ৩০ লিটার। এভাবে প্রতিদিন ১০০ লিটার রস সংগ্রহ হয় সম্ভব। তরল রস আগুনে জ্বাল দিয়ে প্রতি কলসিতে প্রায় সাড়ে তিন কেজি গুড় উৎপাদন করা হয়। এখানে একটা কথা বলা প্রযোজন, শিয়ালের উপদ্রপ আছে, পাতি শৃগার হাড়ি ভেঙ্গে ফেলে আবার রশি ছিরে হাড়ি নিয়ে যায়। সাবধানতা অবলম্বন করার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া গাছের তিন-চার ফুট লম্বা পাতা দিয়ে তৈরি হয় ঘরের ছাউনি। ১০০ পিস ছাউনি বিক্রি করা হয় ৬০০ টাকায়। প্রায় ১০ থেকে ২০ ফুট লম্বা ডাণ্ডাসহ গোলপাতা ৮০ পিস বিক্রি করা হয় ৪০০ টাকায়। 'লাকড়ি হিসেবে গোলপাতা বাগানের মরে যাওয়া মুথা (ডাটা) ব্যবহার করা হয়। এই মুথা দিয়ে পুরো বছর ধরে চলে রসসহ আমাদের সংসারের রান্নার কাজ।'
কলাপাড়া এলাকার গোলবহরের (বাওর) একজন মালিকের 'গোলবাগান থেকে যে লাভ হয় তা সরল জমিতে ধানচাষ করে হয় না। সাধারনত লোনা পানিতে ধান চাষ তেমন ভাল হয় না। তাছাড়া এক একর জমিতে ধান পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ২৫ মণ। ৭০০ টাকা মণ দরে বাজারে ধান বিক্রি করে প্রতি বছর সাড়ে ১৭ হাজার টাকা আয় হবে। কিন্তু ওই জমিতে সৃষ্টি হওয়া গোলগাছের বাগান দিয়ে প্রতি বছর আমার আয় হয় প্রায় এক লাখ টাকা। এভাবে সাড়ে তিন মাস রস দিয়ে গুড় তৈরি করা সম্ভব। শুধু গুড় দিয়ে প্রায় এক লাখ টাকা আয় হয়। গোলপাতা দিয়ে আরো ২০ হাজার টাকা আয় হয়। কলাপাড়া পৌর শহরে বিক্রি হয়। বরিশাল শরুপকাঠি থেকে বড় বড় নৌকা আসে, তারা এই গোল পাড়া কিনে নিয়ে যা্য়। আমার বাব ও দাদার যুগ থেকে রস সংগ্রহ করেতে দেখেছি। তবে সরকারি উদ্যোগে আন্ধারমানিক নদের তীরে জেগেওঠা চরে গোলগাছ রোপণ করার সুযোগ করে দেওয়া হলে প্রচুর অর্থ আয় হতো । তবে নিজ উদ্যোগে নদীর চরে গোলবাগান করার চেষ্টা করা হলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের গরু-মহিষের অত্যাচারে তা নষ্ট অইয়া যায়। সুষ্ঠ রক্ষনাবেক্ষন একান্ত প্রয়োজন রহিয়াছে।
গোলপাতার রস খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশী, 'গোলের রস খেলে পেটের কৃমি দমন হয়। মানুষের শরীরের পানিশূন্যতা দূর করে, কর্মক্ষমতা বাড়ায়। আখের রসে শর্করা থাকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। গোলগাছের রসে শর্করা থাকে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ।'
কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, চাকমাইয়া, টিয়াখালীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধের খাদায় কিংবা খালের তীরে গোলবহর রয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের দিকে বন বিভাগের উদ্যোগে প্রথমে সুন্দরবন থেকে গোলবহরের বীজ (গাবনা) সংগ্রহ করে রোপণ করে বাগান তৈরি করা হয়। এরপর থেকে স্থানীয়রাও নিজ উদ্যোগে কৃষি জমির অভ্যন্তরের খালের তীরে গাবনা রোপণ করে বাগান তৈরি করেন। কলাপাড়াসহ উপকূলীয় এলাকায় গোলগাছের গুড়ের চাহিদা রয়েছে অনেক। এটি এ অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি খাবার হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি গোলগাছ পাতাসহ উচ্চতা হয় ১২ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত। এর ফুল হয় হলুদ এবং লাল। ফুল থেকে গাবনা পরিপক্ব হলে সেটি তালগাছের আঁটির মতো কেটে শাস খাওয়া যায়। এ গাছ নোনাজলে জন্মায় এবং সুস্বাদু গাবনা দিয়ে গাছ গজায়।'
আমি এই গোলগাছের ভীতরে জন্ম নিয়েও এত কিছু জানা ছিল না। অনেক কিছু গেটে পড়ে বুঝতে পারলাম এটা একটা সুন্দর বিষয় তাই এই লেখা প্রকাশ করলাম। আমি আখের রস, তালের রস, খেজুর রস, খেয়েছি কিন্তু গোলের রসের স্বাদ কোনটার মধ্যে পাইনি। নারিকেল অথবা মহিষের দুধের সাথে গোলের মিঠাই যে না খেয়েছে। তাকে দক্ষিন বাংলার মানুষ ভাবাই খুব কঠিন বলে আমি মনে করি। মহিষের দুধের সাথে গোলের মিঠাই মাখালে যে, ফেনা উঠে, মলে হলে আজও জিবে জ্বল আসে, তাতে কোন সন্ধেহ নাই। আপনারা যারা কুয়াকাটা যাবেন, তারা একবার পরক্ষ করতে পারেন। আমার কথা কতটা সত্য।
পরিশেষে ছোট্ট একটি ভাললাগা সবার সাথে শেয়ার করার জন্য আমি আনন্দিত। আসুন আমরা কুযাকাটা ও পায়রা নদীর পার ভ্রমন করি আমার দেশকে একটু ভালবেশে ভ্রমন করি, জানি, দেখি ও শুনি।
গোলপাতা, শুনলেই মনে হয পাতাটা গোল আসলে এর পাতা গোল নয়, কিন্তু তারপরেও তার নাম গোলপাতা। এটি মূলত পাম জাতীয় বৃক্ষ। বৈজ্ঞানিক নাম Nypa fruticans।
এই গাছগুলো নদীর পার জুড়েই জন্মে তবে জোয়ার ভাটা থাকতে হবে এবং লবনা্ক্ত পানিতেই তার বেশী দেখায়। গোলপাতার গাছ বাংলাদেশের সুন্দরবন ছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দেশের সমুদ্রতীরবর্তী অংশে জন্মে। বাংলাদেশ ছাড়া ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ভিয়েৎনাম, শ্রীলঙ্কায় জম্মাতে দেখা যায়।
এর পাতা নারিকেল পাতার মত এক প্রকার লম্বা পাতা বিশিষ্ট গাছ বিশেষ। পাম গোত্রের তালগাছ সদৃশ এই গাছ আকৃতিতে ছোট। এর কাণ্ড মাটির নিচে অনুভূমিক বিস্তার লাভ করে। শুধু এর পাতা এবং ফুল মাটির উপরে দৃশ্যমান হয়। এর ডাঁটাসহ পাতার ফলক দৈর্ঘ্য ৮ থেকে ১০ ফুট হয়ে থাকে।
এর লাল রঙের স্ত্রীফুল উপরের দিকে ফোটে। পক্ষান্তরে হলুদ পুরুষ ফুলগুলো অপেক্ষাকৃত নিচুতে ফোটে। এর ফল জাম্বুরা মত বড়। ঘর ছাওয়া ও ঠোঙা বানানোর জন্য গোলপাতা ব্যবহার করা হয়। গোলপাতার ফল অনেকটা তাল শাঁশের মত।
এই গাছের পাতা ঘরের চাল ছাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
ভোলার চরাঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র পরিবারের কাছে এখনো জনপ্রিয় বনের গোলপাতা। অল্প টাকায় তৈরি হয় গোলপাতার ঘর। ফলে তারা গোলপাতায় তৈরি ঘর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত ইউনিয়নের নাম চর কুকরী-মুকরী। এখানে রয়েছে বন বিভাগের ৮ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল। নান্দনিক এসব বনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খালের দুই পাড়ে ও ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে নারিকেল গাছের পাতার মতোই ছোট ছোট গোলপাতা গাছ। বন বিভাগের আওতায় চরাঞ্চলে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য এসব গাছ রোপণ করা হয়ে থাকে। বন প্রহরীরা এসব গাছের পরিচর্যা করেন। নিজস্ব নার্সারিতে গোলপাতা গাছের বীজ রোপণের পর পরিচর্যার এক পর্যায় ৯ থেকে ১০ ইঞ্চি হলে সেগুলো নিয়ে খালের পাড়ে এবং বনের ভেতরে রোপণ করা হয়।
অপরদিকে তাদের নিজেদের থাকার ভালো ঘর না থাকলেও বন বিভাগ গোলপাতার বাগানের পরিচর্চা করে । চরাঞ্চলের অধিকাংশ লোকই হতদরিদ্র অল্প টাকায় ঘর নির্মাণের জন্য সহযোগিতা করাই বন বিভাগের আসল উদ্যেশ। একই সাথে এ কাজে তাদের আনন্দ লাগছে। বন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বনের পাশেই হতদরিদ্র পরিবারগুলোর বসবাস। কৃষিকাজ আর নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করাই এসব পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কাজ। তাই টিনের ঘর করা তাদের পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় গোলপাতাই তাদের প্রধান ভরসা। ২৫ হাজার টাকা ব্যয়ে একবার ঘর নির্মাণ করলে ৫ বছর কেটে যায়। তাছাড়া এই ঘর গুলো বসবাসের জন্য বেশ আরামদায়ক হয়। গরমের সময় বেশী গরম হয় না। এবং শীতের সময়ও বেশী শীত লাগে না।
আপনী যদি তাদের কাছে জানতে চান যে, গোলপাতার ব্যবহার সম্পর্কে তারা বলবে, একবার গোলপাতা দিয়ে ঘর নির্মাণ করলে তাদের ৫ থেকে ৭ বছর কেটে যায়। এছাড়া নাড়া (ধানের নিচের অংশ) দিয়ে ঘর করলে প্রতিবছর সংস্কার করতে হয়। আর তাদের পক্ষে টিনের ঘর তৈরি করা সম্ভব হয় না বলে গোলপাতাই হচ্ছে তাদের একমাত্র ভরসা। নাড়া দিয়ে ঘর তৈরি করলে এক বছর স্থায়ী হয় আর গোলপাতা দিয়ে করলে ৫ থেকে ৭ বছর স্থায়ী হয় বলে গরিব মানুষেরা গোলপাতার ঘর তৈরি করেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সরকার নির্ধারিত রেভিনিউয়ের মাধ্যমে গোল গাছের এসব পাতা বিক্রি করা হয়ে থাকে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ঘুটাবাছা গ্রামের গোলগাছের রস সংগ্রহের জন্য ডগা ধারালো দা দিয়ে সূক্ষ্মভাবে কাটা হচ্ছে।
নোনাজলে জন্ম, নোনা সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অথচ এর ডগা (ডাণ্ডি) থেকে বেরিয়ে আসছে মিষ্টি রস। সেই রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড় (মিঠা)। সুস্বাদু এই গুড়ের চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। মুখে নিলেই অভিজ্ঞরা বুঝতে পারেন এর স্বাদের ভিন্নতা। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি পরিবার কয়েক বছর ধরে এই গুড় তৈরি করছে। এখানে গোলপাতার চাষও করা হয়।
কলাপাড়া-কুয়াকাটা সড়কটি নীলগঞ্জ ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বরাবর চলে গেছে বঙ্গোপসাগরের সৈকতের দিকে। সড়কটি ধরে দক্ষিণে চলতেই রাস্তার ধারে একাধিক স্থানে চোখে পড়ে গোলপাতা গাছের বহর (বাগান)। এমন একটি বহর থেকে রস সংগ্রহ করছেন নীলগঞ্জের ঘুটাবাছা গ্রামের চাষিরা। সকাল-বিকেল দুই বেলা চলে তাঁর গোলপাতা গাছের ডগা কাটার কাজ। দুবেলাই রস পাওয়া যায, এবং তাপাল বা পাতিলে জ্বালাইয়া মিঠা তৈরি করা হয়, এর মিঠা বেশ সুস্বাদু, এগুলো কলাপাড়া বাজারে ৭০/৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। মুখে তুলতেই বুঝা যাবে এটা গোলের মিঠাই, এর পিঠা ও পায়েশের স্বাদই আলাদা, বেশীর ভাগ মিঠাতেই রওয়া পরে যায়, মিশ্রির দানার মত যে একবার খেয়েছেন, নিশ্চই তিনি বার বার খেতে চাইবেন।
সাধারনত আষাঢ় মাসে গোল গাছের ডাণ্ডিতে গাবনা ফল হয়। পৌষ মাসে ফলসহ মাটিচাপা দিয়ে ডাণ্ডি নুয়ে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসে ডাণ্ডিটি মানুষের পায়ের আলতো লাথি দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে রসে ভার করার জন্য দোয়ানো হয়। ১৫ দিন এভাবে দোয়ানোয় পর গাবনা ছড়ার আগাছা পরিষ্কার করে ডগার মাথা থেকে গাবনা ফলের থোকা ধারালো দা দিয়ে এক কোপে কেটে ফেলা হয়। এরপর ডাণ্ডির কাটা অংশ তিন দিন শুকিয়ে নেওয়ার পর সকাল-বিকেল দুইবেলা পাতলা করে (একসুত পরিমাণ) কেটে ফেলা হয়। এভাবে চলে আরো ১৫ দিন। এরপর প্রতিদিন বিকেলে একবেলা ডাণ্ডার মাথা দিয়ে কিঞ্চিত অংশ কেটে রশির সঙ্গে একটি ছোট্ট হাঁড়ি বেঁধে রাখা হয়। পরদিন খুব ভোরে রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতি বছর পৌষ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে রস সংগ্রহ করা। প্রতিটি ডাণ্ডি থেকে ২৫০-৫০০ গ্রাম পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। কমপক্ষে এক একর জমির বাগানের ১৫০টি ডাণ্ডি থেকে প্রতিদিন রস সংগ্রহ হয় ৪/৫ কলসি। প্রতি কলসিতে রস ধারণক্ষমতা ২৫ থেকে ৩০ লিটার। এভাবে প্রতিদিন ১০০ লিটার রস সংগ্রহ হয় সম্ভব। তরল রস আগুনে জ্বাল দিয়ে প্রতি কলসিতে প্রায় সাড়ে তিন কেজি গুড় উৎপাদন করা হয়। এখানে একটা কথা বলা প্রযোজন, শিয়ালের উপদ্রপ আছে, পাতি শৃগার হাড়ি ভেঙ্গে ফেলে আবার রশি ছিরে হাড়ি নিয়ে যায়। সাবধানতা অবলম্বন করার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া গাছের তিন-চার ফুট লম্বা পাতা দিয়ে তৈরি হয় ঘরের ছাউনি। ১০০ পিস ছাউনি বিক্রি করা হয় ৬০০ টাকায়। প্রায় ১০ থেকে ২০ ফুট লম্বা ডাণ্ডাসহ গোলপাতা ৮০ পিস বিক্রি করা হয় ৪০০ টাকায়। 'লাকড়ি হিসেবে গোলপাতা বাগানের মরে যাওয়া মুথা (ডাটা) ব্যবহার করা হয়। এই মুথা দিয়ে পুরো বছর ধরে চলে রসসহ আমাদের সংসারের রান্নার কাজ।'
কলাপাড়া এলাকার গোলবহরের (বাওর) একজন মালিকের 'গোলবাগান থেকে যে লাভ হয় তা সরল জমিতে ধানচাষ করে হয় না। সাধারনত লোনা পানিতে ধান চাষ তেমন ভাল হয় না। তাছাড়া এক একর জমিতে ধান পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ২৫ মণ। ৭০০ টাকা মণ দরে বাজারে ধান বিক্রি করে প্রতি বছর সাড়ে ১৭ হাজার টাকা আয় হবে। কিন্তু ওই জমিতে সৃষ্টি হওয়া গোলগাছের বাগান দিয়ে প্রতি বছর আমার আয় হয় প্রায় এক লাখ টাকা। এভাবে সাড়ে তিন মাস রস দিয়ে গুড় তৈরি করা সম্ভব। শুধু গুড় দিয়ে প্রায় এক লাখ টাকা আয় হয়। গোলপাতা দিয়ে আরো ২০ হাজার টাকা আয় হয়। কলাপাড়া পৌর শহরে বিক্রি হয়। বরিশাল শরুপকাঠি থেকে বড় বড় নৌকা আসে, তারা এই গোল পাড়া কিনে নিয়ে যা্য়। আমার বাব ও দাদার যুগ থেকে রস সংগ্রহ করেতে দেখেছি। তবে সরকারি উদ্যোগে আন্ধারমানিক নদের তীরে জেগেওঠা চরে গোলগাছ রোপণ করার সুযোগ করে দেওয়া হলে প্রচুর অর্থ আয় হতো । তবে নিজ উদ্যোগে নদীর চরে গোলবাগান করার চেষ্টা করা হলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের গরু-মহিষের অত্যাচারে তা নষ্ট অইয়া যায়। সুষ্ঠ রক্ষনাবেক্ষন একান্ত প্রয়োজন রহিয়াছে।
গোলপাতার রস খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশী, 'গোলের রস খেলে পেটের কৃমি দমন হয়। মানুষের শরীরের পানিশূন্যতা দূর করে, কর্মক্ষমতা বাড়ায়। আখের রসে শর্করা থাকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। গোলগাছের রসে শর্করা থাকে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ।'
কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, চাকমাইয়া, টিয়াখালীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধের খাদায় কিংবা খালের তীরে গোলবহর রয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের দিকে বন বিভাগের উদ্যোগে প্রথমে সুন্দরবন থেকে গোলবহরের বীজ (গাবনা) সংগ্রহ করে রোপণ করে বাগান তৈরি করা হয়। এরপর থেকে স্থানীয়রাও নিজ উদ্যোগে কৃষি জমির অভ্যন্তরের খালের তীরে গাবনা রোপণ করে বাগান তৈরি করেন। কলাপাড়াসহ উপকূলীয় এলাকায় গোলগাছের গুড়ের চাহিদা রয়েছে অনেক। এটি এ অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি খাবার হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি গোলগাছ পাতাসহ উচ্চতা হয় ১২ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত। এর ফুল হয় হলুদ এবং লাল। ফুল থেকে গাবনা পরিপক্ব হলে সেটি তালগাছের আঁটির মতো কেটে শাস খাওয়া যায়। এ গাছ নোনাজলে জন্মায় এবং সুস্বাদু গাবনা দিয়ে গাছ গজায়।'
আমি এই গোলগাছের ভীতরে জন্ম নিয়েও এত কিছু জানা ছিল না। অনেক কিছু গেটে পড়ে বুঝতে পারলাম এটা একটা সুন্দর বিষয় তাই এই লেখা প্রকাশ করলাম। আমি আখের রস, তালের রস, খেজুর রস, খেয়েছি কিন্তু গোলের রসের স্বাদ কোনটার মধ্যে পাইনি। নারিকেল অথবা মহিষের দুধের সাথে গোলের মিঠাই যে না খেয়েছে। তাকে দক্ষিন বাংলার মানুষ ভাবাই খুব কঠিন বলে আমি মনে করি। মহিষের দুধের সাথে গোলের মিঠাই মাখালে যে, ফেনা উঠে, মলে হলে আজও জিবে জ্বল আসে, তাতে কোন সন্ধেহ নাই। আপনারা যারা কুয়াকাটা যাবেন, তারা একবার পরক্ষ করতে পারেন। আমার কথা কতটা সত্য।
পরিশেষে ছোট্ট একটি ভাললাগা সবার সাথে শেয়ার করার জন্য আমি আনন্দিত। আসুন আমরা কুযাকাটা ও পায়রা নদীর পার ভ্রমন করি আমার দেশকে একটু ভালবেশে ভ্রমন করি, জানি, দেখি ও শুনি।
Comments
Post a Comment