একটি বালকের জীবন গাথা

আমাকে যেতে হবে নারায়নগঞ্জ, যদি বাসে করে যাই তবে সময় লাগবে, ৫/৬ ঘন্টা আর যদি ট্রেনে যাই তবে সময় লাগবে সর্বউচ্চ ২ ঘন্টা। বাসা থেকে নতুন বিমান বন্দর রেল স্টেশন, টিকিট কাটতে যতটা সময় লাগলো, ট্রেন এসে গেল, উঠে পড়লাম। যেহেতু ইন্টার সিটি ট্রেন সময় লাগলো না। বিমান বন্দর থেকে কমলাপুর আসতেই সময় লাগলো মাত্র আধা ঘন্টা । ছোট্ট বেলার বন্দুর সাথে দেখা, তাকে সময় দিতে গিয়ে আমি নারায়নগঞ্জের ট্রেন দুই/এক মিনিটের সময়ের ব্যবধানে হারাতে হলো। কিছুই করার নাই, দুই ঘন্টা অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন কিছুই করার নাই, টাউনের প্রায় রাস্তাই খোরাখুড়ির কাজ চলছে, তাই সাহস হারাইয়া ফেলেছি। রামপুরা, বাড্ডা সমস্ত রাস্তাই খোড়াখুড়ির কাজ চলছেই। আর একটা কথা না বললেই নয়, ঢাকার রাস্তার কাজগুলো সাধারনত: এই বর্ষার দিনেই শুরু হয়। জানি না তার পিছনে কি কারন আছে, এক মাত্র ইঞ্জিনিয়র সাহেবরাই জানেন, তবে এটা যে কোন লোকই পছন্দ করেন না, তা আমি হলফ করে বলতে পারি, যাই হোক আমি আমার মূল গল্পে ফিরে আসতে চাই।

এক পসরা বৃষ্টি হলেও গরম কুমছে না। মানুষ হাপাচ্ছে আর হাপাচ্ছে, কোথায় দাড়াবো জায়গা খুৃজতে ছিলাম এমন সময় চোখে পড়লো, একটি বেঞ্চিতে ছোট্ট বালক তার বয়স ১১/১২ হতে পারে, গায়ে একটি পুরাতন গেঞ্জি, পরনে প্যান্ট যা তাহার অসাহায়ত্বের স্বাক্ষী বহন করছে, সারাদিন কোন ওয়ার্কশপে কাজ করেছে, নাক, মুখ ও চেহারায় কালিতে মাখা, দেখে বুঝতে আর বাকি খাকলো না্। দিন রাত্রি হাড় ভাঙ্গা খাটুনি তাকে যে দুর্বল করে দিয়েছে, তার চুলগুলো কালিও ময়লায় মাখা। আমি তর পার্শ্বেই একটু জায়গা করে নিলাম, এবং বসার জন্য অনুমতি চাইলাম। অনুমতি পাওয়া গেল, এবার তার সাথে একটু ভাব জমাতে চেষ্টা করলাম, তার জীবনের দুঃখটা একটু শেয়ার করার চেষ্টা করলাম, এবং ১০ টাকার বাদাম ভাগাভাগি করার চেষ্টা করলাম, প্রথমতঃ রাজি হতে চাইলো না, পড়ে সে বুঝতে পারলো যে, আমি তার কষ্টের ভাগী হতে চাই, তখন সে ঠিকই তার কষ্টো আমার সাথে শেয়ার করার জন্য আগ্রহী হলেন। সে আস্তে আস্তে আমার কাছে তার কষ্টের দুয়ার খুলে দিল, আমি তাতে প্রবেশ করলাম।

তারা চার ভাইবোনের মধ্যে দুই ভাই, দুই বোন। তারা দুই ভাই একটি ফ্রিজের ওয়ার্কশপে কাজ করেন। সে এখন তার বাসায় বড় ভাইয়ের জন্য খাবার আনবে ও নিজে খেয়ে আসবে, দুই দিন হলো গোসল করে নাই। তাই বড় ভাই তাকে বাসা যাওয়ার কথা বললে তিনি ট্রেনেই যাবে, কারন ট্রেনে ভাড়া ছাড়াই যাতায়াত করা সম্ভব। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, টিটি তোমার কাছে টাকা চায় না, সে বললো, প্রথম প্রথম চাইতো এখন আর চায় না, সবাই চিনে ফেলেছে। চাইলেই বা কি করার আমি তো ভাড়া দিতে পারবো না, তা তারা জানে, সেই জন্য আর ভাড়া চায় না।

আমার একটু জানার ইচ্ছা জাগলো সে কেন লেখা পড়া ছাইড়া এই কাজ করতে আসলো, তার কি লেখা পড়া করা ইচ্ছা নাই, না কোন সমস্যা, মন টা বড়ই বেকুল হয়ে উঠলো।

এই বয়সে তার থাকার কথা ছিল কোন প্রাইমারী স্কুলে, হাতে থাকার কথা ছিল বই, খাতা, কলম, কিন্তু হায় ভাগ্য, আজ সে কোথায়, এই কি তার পরিনতি। কেমন এমন হলো। হু, হু করে মনটা নিজের অজান্তেই কেঁদে উঠলো, কাউকে দেখাতে না পারলেও, ঐ ছেলেটি ঠিকই বুঝতে পারলো, তখন সে বলতে আরম্ভ করলো, " আঙ্কেল, আমার বাবা ছিল, কাপড়ের ব্যবসা করতো, নরসিংদী থেকে কাপড় আনতো এবং নারায়গঞ্জ বিক্রয় করতো, আমরা একটা ব্লিডিং এ ভাড়া থাকতাম, আমার ভাইয়া স্কুলে পড়তো, আমি কেজি স্কুলে পড়তাম, কিন্তু আমার আব্বা মরার পর, আর স্কুলে যাইতে পারি না, তার পরও লেখা পড়ার চেষ্টা করি। দেখি আল্লাহ কি করেন। আশার আলো দেখলাম কিন্তু সে আলোর রৌশন খুব কম, আলোকিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষিন। কিন্তু মানুষ তো আশা নিয়েই বেচে থাকতে চায়। জীবন কে এমন হয়, বার বার একই প্রশ্নই মাথা চারি দিকে ঘুরপাক খাচ্ছে।

জানতে চাইলাম তোমার বাবা কি ভাবে মারা গেলে, " আমার বাবার কাপড়ের ব্যবসা ছিল, তিনি একদিন বেচাকেনা শেষে টাকা নিয়ে বাসায় ফিরছেন, এমন সময় রাস্তায় সন্ত্রাসীরা তার সমস্ত টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে গেল এবং তাকে মারধর করে ছিল। তিনির কাছ থেকে যখন টাকাগুলো কেড়ে নিয়ে গেল, সাথে সাথে তিনির হাড এ্যাটাক্ট হলো, এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি কর হলো, প্রথমত: তার টাকা হারানো, দ্বিতীয়ত: তার চিকিৎসা, এতে করে তার পরিবার এক সময় নি:স্ব হলে গেল"।

এর প্রধান কারন হলো, সন্ত্রাস, এই সন্ত্রাসই একটি পরিবারকে সর্বশান্ত করে ছাড়লো, কিন্তু এই সমাজ তার জন্য কিছুই করতে পারলো না। প্রশাসন কোন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা তো দুরে থাক কোন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া প্রয়োজন মনে করে নাই। এমনই প্রকাশ পেল ছেলেটির কথায়। এক সময় এই পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিটির জীবন প্রদ্বিপ নীভে গেল বটে, তখন তার পরিবারের জন্য কোন অর্থ আর অবশিস্ট থাকলো না। এবার একটি নারী এবং তার সন্তান ও বাচাঁর লড়াই, এই তিনটি শব্দ একত্রে এসে হাজির হলো এবং দাত কেলিয়ে হাসতে আরম্ভ করলো, তাদের প্রধান শত্রু "অভাব"। আর এই অভাবের সাথে লড়াই করতে হচ্ছে এক অসহায় নারীকে। হতে হলো অন্য পরিবারের বুয়া, তার পর সন্তানের মুখে ভাত। এই যায়গায় না দাড়িয়ে এই কষ্টটা বুঝতে পারা খুবই অসম্ভব। হাজারো কষ্টের মাঝে একজন মা, তার সন্তানদেরকে যে, এতটা সৎ ও ভদ্র রাখতে পেরেছেন, এজন্য ঐ মাকে আমি সালাম জানাই। ধন্য তুমি মা, ধন্য তোমার আদর্শ। " আমাকে একজন আদর্শ মা দাও, আমি তোমাকে একটি আদর্শ জাতী উপহার দেব।" এটাই আমার সামনে পরিস্কার হয়ে ধরা দিল।

ট্রেন এসে গেল, কিন্তু ছাড়তে দেড়ি আছে, আমরা দু'জন পাশ্বা পাশ্বি সীটে বসলাম কিন্তু সময় অনেক বাকি, ছেলেটির মুখের কথা গুলো সুধুই সুনলাম, কোন জবাব আমি তাকে দিতে পারি নাই। আমার কাছে কেন, সমাজের কোন লোকের কাছেই এই সব কথার সঠিক উত্তর আছে কিনা, তা আমার জনা নাই। সুধুই দু'চোখের পানি ছেড়ে দিলাম আর মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে ফানা চাইলাম। কারন আমি যে, আজ নারায়নগঞ্জ যাচ্ছি, তাও একটি অমানবিক ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে। আমি আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও সন্ত্রাসীর শিকার আর এই লোক তো তার তুলনায় কিছুই না। সুধুই দু'চোখের পানি ছাড়লাম আর ভাবলাম, কোন সময় যে ট্রেনের রাস্তা শেষ হয়ে গেল বুঝতেও পারলাম না। ছেলেটি আমাকে ধাক্কা দিয়ে চেতনায় আনলেন, এবং বললেন, স্যার আমরা এসেগেছি। ট্রেন থেকে নামলাম এবং ছেলেটিকে ডেকে একটা রেষ্টুরেন্টে নিয়ে দু'জনে ভাত খেলাম। যদিও সে প্রথমে রাজি ছিল না, আমার অনুরোধে খাইলো, যখন আমার পরিপূর্ন পরিচয় তাকে দিলাম এবং আইডি কার্ড দেখালাম।

আমার এই সত্যি কাহিনীটা জানার পর হয়তো আমার অনেক বন্ধু, আমার কাছে সেই ছেলেটির পরিচয় বা ছবি দেখতে চাইবে। তাতে হিতে বিপরিতও তো হতে পারে, আমরা যেন সেই পথে না হাটি, তবে আমি খুশি হয়েছি, তারা দু'ভাই এনজিও স্কুলে পড়াশুনাও করে।

কামার যখন তাহার লোহাকে চুলায় ডুকায়, তখন থাকে সেটি একদম কাচাঁ, আগুন জ্বালাইয়া যখন হাপড় টানে, আস্তে আস্তে তাতে আগুনে পুড়ে নরম হয় এবার কামার তার ইচ্ছা মত তাতে আকার দেওয়ার জন্য পিটাতে থাকেন। তাই আমি কিছুই বলতে পারলাম না, আমার মাঝে মানবিকতাটা এতটাই দগ্ধ হতেছিল যে, যাহা ঐ হাপড়ের চাইতেও কয়েকশত গুন বেশী।

সন্মানিত পাঠক, আমরা প্রত্যেকের মাঝে মানবতার যন্ত্রটাকে একটু হলেও স্বচেতন করি, তাতে করে এই অসহায় মানুষগুলো, যদি একটু হলেও বাচাঁর আশা করতে পারে। এই পৃথিবীটা যদি বসবাসের উপযোগী করে রেখে যেতে পারি, তাতে আমাদেরই তো ভাল, কারন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মই তো ভাল থাকবে, তাই না?

Comments

Popular posts from this blog

গোলের রস ও গোলের মিঠা

কাউফল-দেশীয় ফল

কাঠবাদাম হার্ড সুস্থ্য রাখে