সুন্দরবন কত দুর (ভ্রমন কাহিনী)

বাগেরহাটের জোনাল অফিস হতে রওয়ানা হলাম, বাজুয়া সাইটে যেতে হবে। সব কিছু ঠিকঠাক মোটর সাইকেল সহ আমার সহকর্মী অফিসার মাসুদ সাহেব দাড়িয়ে আছে। তিনিই ড্রাইভার এবং আমি তাহার সহ-যাত্রী হিসাবে রওয়ানা হলাম, মাঝে মাঝে অনেকগুলো সাইটে দাড়াতে হলো, সাথে কিছু ডকুমেন্টও অন্যান্য জিনিস পত্র আছে, সে গুলো সাইটে পৌছাতে হবে। হেলমেট পড়া থাকলেও কনকনে শীত গাঁ ছুয়ে যায়ে। মোটর সাইকেলে গতি ৮০ এর কাছাকাছি, কিছু সময়ের ব্যবধানে একটা নৌকা ঘাটে পৌছে গেলাম। আমি তখনও জানি না, আমার গন্তব্য কোথায়। নৌকা পার হলাম, একটি ইউনিয়নে পৌছলাম কিন্তু এটাকে কোন ক্রমেই ইউনিয়ন বলা যাবে না। এখানে ডিগ্রী কলেজ আছে। আছে সরকারী মহিলা কলেজ, ব্যাংক সহ সমস্ত নাগরিক সুবিধা কিন্তু বাধ সাধলো মসজিদ। কোন মসজিদ খুজে পেলাম না। একটি যদিও পেলাম তা আবার তালা বন্ধ। যাই হোক নামাজ পড়া হলো। মোটামোটি বড় একটি প্রজেষ্ট।

একটি ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে উঠলাম। একখানে থাকার জায়গাটা বেশ সুন্দর আমার পছন্দ হয়েছে। এখানে যারা আছে সবাই আমার জুনিয়র, সিনিয়র ইঞ্জিনিয়র সাহেব এখানে থাকেন না। তিনি বাগের হাছে থাকেন, তা ছাড়া তিনি হিন্দু মানুষ, থাকা খাওয়ার হয়তো অসুবিধা হতে পারে বিভিন্ন চিন্তা করে তাকে আমি বেশী বলিও না, থাকার জন্য। তৃতীয় তলায় থাকি, হিন্দু এলাকা এখানে ৯৫% লোকই হিন্দু বললেই চলে কোন আজানের ধ্বনি শোনার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। একটি মাত্র মসজিদ তাও বাজারে। প্রায়ই কাশার শব্দ আর ডোলের শব্দ তো আছেই, পাশ্বা পাশ্বি দুইটি ইউনিয়ন, দুই জন চেয়ারম্যানই হিন্দু, তাও আবার মা-ভাগ্নে। মজার ব্যাপার হলো, তার দুটোই চালবাজ।

জীবনের প্রথম দিকে হয়তো একবার এই এলাকাতে এসে ছিলাম, খুব ছোট বেলায় তবে তখনকার চালনা আর বর্তমানের চালনা এক রকম নাই। অনেক পরিবর্তন এসে গেছে। তা ছাড়া ৪৬/৪৭ বছর আগের কথা ভালভাবে মনেও করতে পারছি না। সব কিছুই যেন স্বপ্নের মত লাগতেছে। চালনা নদীর দৃশ্য আমার মনে গভীরে স্থান করতে পেরেছে। আমি মুগ্ধ হলাম এই মনরম দৃশ্যে। নদীর পারের নদী শাসনের কাজ এবং একটি ঘাট বাধাই করতে হবে, যাতে এলাকর লোকজন পারা পারে সুবিধা হয়। বর্তমান সরকার এই কাজের প্রতি কিছুটা হলেও সচেতন, কিন্তু বাধ সাধলো এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বর সাহেবরা। তাদের অনাধিকার চর্চাটা একটু বেশী, তাদেরকে কাজ করতে দিতে হবে, সেও আবার তাদের বেধে দেওয়া দরে, দর কষা কষি করার কোন জো নাই। আমরা সরকারের কাছে যে রেট পাইনি, কিন্তু তাদেরকে সেই রেট দিতে হবে। মহা মুশকিল হলো, কাজটা কি আদৌ শেষ করা যাবে কিনা, কোম্পানী বিপদেই আছে, তার উপর আবার বিশফোড়া তো আাছেই, আমার কোম্পানীর কিছু অসৎ কর্মচারী তাদের সাথে যোগ দিয়ে কোম্পানীর সর্বনাশ ডেকে আনছে। আর এই জন্যই আমাকে এখানে আসার একমাত্র কারন। কত দিন থাকতে হবে জানি না। কোম্পানীর নির্দেশ লাভ ক্ষতির হিসাব পড়ে, আগে কাজ তুলতে হবে, দেশের উন্নয়ন আগে। এম ডি সাহেব বরাবরই ভালমানুষ, তার চিন্তা ও চেতনায় একজন খাটি দেশ প্রেমিক ও ভাল মানের একজন খাটি ঈমানদার মুসলমান। আমার তাকে ভাল লাগে, সুধু আমারই নয় আপনারও হয়তো আমার চাইতে বেশী ভাল লাগতে পারে, যদি কোন ক্রমে একবার তার সাথে কাজ করার সুযোগ আপনার হয়।

আমার জুনিয়র হিসাব কর্মকর্তা ও ইঞ্জিনিয়র সাহেবরা আমাকে খাবারের পড়ে যানালেন, স্যার, খুব কাছেই সুন্দর বন জঙ্গল, সুনে যতটা খুশি হলাম, তার চাইতে বেশী ভয় পাইলাম, কারন আমি জানি এখানে সুন্দর্য্যের চাইতে বিপদই বেশী পরিমানে অপেক্ষা করছে। সন্ত্রাসী একটি গুষ্টি আছে, যারা নৌকা করে ঘুরে বেড়ায় তাদের প্রধান কাজ হলো মানুষের সকল কিছু কেড়ে নেয়া কোন কারনে, যদি ঝামেলা বেশী হয় তখনই তারা খুনখারাবি করতে পিছ পা হয় না। তার পর যন্তু জানোয়ারের ভয় তো আছেই। কিন্তু মানুষরুপি জানোয়ারের ভয়টা একটু বেশীই বটে। আর আমি যে মিশন নিয়ে এখানে আসলাম, তা মোটেই সুবিধার নয়। যদিও ঘুমে আমার চোখ বুঝে আসছে, সবাই যখন চলে গেল আমার ভয়ের মাত্রা বেড়ে গেল। আমি ঘুমের ভান করলাম, সবাই চলে যাওয়ার পর, নীজ কম্পিউটারে বসলাম, কিছু সময় পর দেখলাম সবাই ঘুমের ঘোড়ে বিভোর ঠিক সেই সময় অর্থাৎ রাত ১টা বাজে, রুমে তালা দিলাম এবং একটু একটু করে নীচে নামলাম। কুকুর ডাকছে, গা ছমছম করছে, কোথায় জানি না কোন বিপদ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সাবধানে পা ফেলার কোন বিকল্প নাই। ইউনিয়ন অফিস থেকে নেমে সোজা ঘাটের দিকে গেলাম, কোন মানুষ জন জেগে আছে কিনা, তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরী। মাঝে মাঝে কাশির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু কোন লোকের আনাগোনা দেখতে পেলাম না।ঘাটে নৌকা বাধা আছে কিন্তু কোন লোক নাই, আমাদের প্রজেক্টের গেটে আসলাম, সবই ঠিকঠাক আছে কিন্তু দারোয়ান ঘুমাচ্ছে। ডাকলাম না। বিপদকে দাওয়াত দিতে আমি রাজি না। নদীর ধারে দাড়িয়ে চাদেঁর আলোতে যতদুর দেখা যায়, অবোলকন করলাম, শীত আছে, বুকের ভীতর ঠান্ডা অনুভব হলো, কিন্তু তার চাইতেও বেশী ঠান্ডা আমার মন, সুনসান চারিদিক, এবার একজন দোকানীকে দেখলাম, তিনি জানতে চাইলেন, আমি কোথায় যাবো, আমি বললাম, ইউনিয়ন অফিসে, আপনী ইঞ্জিনিয়র, জি। আর কোন কথা নাই। তিনি ঘরে গেলেন, নাক ডাকার শব্দ পেলাম, ছোট্ট ছোট্ট কথা গুলাও যেন প্রায় স্পষ্ট সুনা যায়। দু'টো পাতিশৃগাল এসে আমার সামনে হাজির, রাস্তায় উন্নয়নের কাজ চলছে, তাই ইটা পেতে আমার বেশী কষ্টই হলো না। ছুড়ে মাড়লাম ভয় পায় না, কি করি, একটি কেওড়া গাছের ডাল পেয়ে গেলাম, একটি কুকুর আমার সহযোগীতায় আসলো, মনে হয় ঐ কুকুরটাই ওদের ভয়ে পালিয়েছিল। ঠিক বাজার শেষ, এবার বাধের উপর উঠতে দুটো লোক দেখলাম তারা আমাকে দেখে একটু পাশ্বে গেল আমি আর তাদের কোন কথা না বলে সামনে হাটলাম, যেহেতু তার আমাকে দেখে লুকাতে চাইছে, তাই আর ঝামেলা না বাড়িয়ে সামনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। ইউনিয়ন অফিসে উঠতে যাবে ঠিক এমন সময় আবার কুকুর গুলো সেই রকম চেচামেচী আরম্ভ করলো, খুব তারা তারি উপরে উঠে এলাম, একজন ইঞ্জিনিয়র দরজা খুললো, স্যার আপনী? বাথরুমে গিয়ে ছিলেন? মাথা নাড়লাম, কিছুই বললাম না। তিনি বাথরুমের দিকেই গলে। রুমে ডুকে একটু গরম হতে হবে ও ডাইরীতে লেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে আজান হলো, অজু করে নামাজ পড়ে, ঘুমাবার চেষ্টা করলাম কখন যে চোখের কোণে ঘুম হসে গেল, বুঝতেই পারলাম না। যখন নয়টা বাজে তখন নাস্তার জন্য ডাকলো, উঠলাম গোসল করলাম, ও নাস্তা সেরে, অফিসের সাথে যোগাযোগ করলাম।






স্যার হোন্ডা অপেক্ষা করতেছে, বাহিবে যেতে হবে। গতকালকে প্রোগ্রাম তৈরি করা আছে। হোন্ডা দিয়ে প্রোজেক্ট দেখতে হবে। মাটির ও আধাপাকা রাস্তা যথেস্ট বেগতিক রাস্তার ধারা, তবুও যেতে হবে। একটা হাইস্কুলের সামনে হাজির হলেম, রাস্তার বিপরিত দিকেই সুন্দরবনের পরিচিত গোল পাতা দেখা গেল, জানতে চাইলোম, এই গ্রামের নাম কি?, স্যার এটা গ্রাম না, এখান থেকে সুন্দরবন আরম্ভ, অভাক দৃষ্টিতে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম, কতনা সুন্দর দৃষ্টটা যা যে কেহর মন কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। স্যার, মাঝে মধ্যে হরিন এখানে দেখতে পাওয়া যায়। এখানে যে হরিন আসে? তবে তো বাঘও আসে? স্যার, হরিনের মাংস খাবেন? আমি জানতে চাইলাম, হরিন ধরা কি নিষেধ না? স্যার, এখান লোকেরা ফরেষ্টের লোকের চোখ ফাকি দিয় ঠিক ধরে ফেলে এবং জবাই করে মাংস বিক্রয় করে। একজন মাংস এনে আমাকে দেখালো, আমার কেন যেন মনে হলো, এটা হরিনের মাংস না, শুকর বা কুকুরের মাংস। এখানকার মানুষগুলো খুবই দুর্বল, গরু গুলোও দুর্বল, কিন্তু কুকুর ও শুকর এতো মোটা তাজা ভাবা যাবে না। তাই সন্ধেহর মাত্রাটা বেড়ে গেল। সাথে সাথে আমি নিষেধ করলাম, আমি হরিনের মাংস খাবো না। নানা প্রশ্ন উঠে এলো, কখন আমি তাদেরকে বললাম, আমার বাড়ী এই দক্ষিন এলাকাতেই, আর হরিনের মাংষ লবন লাগে তাই আমি পছন্দ করি না। তাছাড়া আমি বেআইনী কাজ গুলো ঘৃনা করি। এ ব্যাপারে কেউ আমাকে অনুরোধ না করলেই আমি বেশী খুশি হবো। একটু সামনে যেতেই কিছু কাকড়া পেলাম, তা কিনতে বললাম, কিন্তু তাতে তাদের অনিহা প্রকাশ পেল, আমি জানি চিংড়ী মাছ, আর কাকড়া একই প্রজাতির প্রানি, আমি প্রায়ই এটা খাই। বেশ স্বাদও আছে। তারা উপায় আন্ত না পাইয়া পাচঁ কেজি কাকড়া কিনতে বাধ্য হলো। প্রোজেষ্ট দেখা শেষ করে বাসায় ফিরলাম, এবং এই কাকড়া রান্না করার দিক নির্দেশনা দিলাম, দুপুরের খাবার তৈরি হয়েই আছে। নদীর মাছ, বেশ সুস্বাদু, খাবার শেষে, মিটিং তৈরি আছে। আলোচনা হলো, ইঞ্জিনিযরদের কাছ থেকে তাদে কাজের সুবিধা অসুবিধাগুলো সুনলাম, জন বল দেখলাম, বিভিন্ন দিক নির্দেশনা পেলাম এবং বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিলাম। কথায় আছে না, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী, সে তার হিসাব টা আগে করে রাখে। আমি যে, তার এই কাহিনী ভাল ভাবে জানি, কিন্তু তা তারা মোটেই মানতে রাজি না। মুখ বুঝে সুধুই জানলাম। ১০ দিন গত হলো, কিছুই করতে পারলাম না, আমি একদিকে সব কিছুই গুছা্ইয়া আনি, তাহারা আবার সেটাকে গুলাইয়া ফালাইতে চেষ্টা করেন। উপায় না দেখে সবার অজান্তে মাননীয় এমডি স্যারকে সব কিছু্ খুলে বলার চেষ্টা করলাম। তিনি একবাক্যে আমার সব কথা বুঝে নিলেন, এবং সাথে সমাধান দিয়ে দিলেন, পরের দিন সকালবেলা দুইজন ডাইরেক্টর এসে হাজির হলেন এই প্রোজেক্টে। তারা অক্লান্ত চেষ্টা করে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভূল করলেন না। আ্মার পরিবর্তে একজন অফিসার ঢাকা থেকে পাঠালেন, তাকে সব কিছু বুঝাতে চেষ্টা করলাম এবং পরিপূর্ন ভাবে বুঝিয়ে দিলাম।

হোন্ডার পিছনে বসে প্রোজেক্টে গেলাম, যেখানে কাজ চলতেছে ঠিক ওখানেই হোন্ডা দাড় করালাম, তখন একজন বৃদ্ধ বয়সি মহিলা এসে সালাম জানালেন, কিন্তু তিনি খৃষ্টান, তার ব্যবহারের আসলেই মুগ্ধ হলাম। বয়সের পরিধী তার গায়ের চামড়া স্বাক্ষী দিতেছে। মাটি কাটার ব্যাপারে তার কিছু অনুরোধ রাক্ষা করাই তার আসল উদ্যেশ। তার বাড়ীটা একটা একতলা বিল্ডিং, খুবই সাজানো ও গোছানো, প্রায়ই আমার চোখের পড়েছে, খিৃষ্টানদের বাড়ীগুলো খুব গুছানো, ও পরিস্কার করে রাখার চেষ্টা করে। ভদ্র মহিলার ৬ জন সন্তান তার সবাই উচ্চ শিক্ষিত তার কাছে কেউ নেই সবাই বাহিরে, কেউ আমেরিকা, কেউ কানাডা, কেউ ঢাকায়, মাঝে মধ্যে বেড়াতে আসে, আবার আসে না। জীবন যুদ্ধের এই যোদ্ধা, আসলেই স্বার্থক, তার সর্ব ছোট সন্তানের বয়স যখন এক বৎসর তখন তার স্বামী মারা যান, এবং ছোট্ট সন্তান ৩৮ বৎসর বয়স, তা একবার ভেবে দেখুন, তার এই যুদ্ধের বয়স কত। যেখানে একজন পুরুষ যা পারে না, হেরে যায়, সেখানে একজন মহিলা ৬টি সন্তানের লেখা পড়া ও বড় করা একটা্ কঠিন যুদ্ধ ছাড়া আর কি হতে পারে। আমি এই গাজী যোদ্ধাকে আমার সাধুবাদ জানেতে মোটেও কৃপন্য করিনী।



পৃথিবীর সব কিছুই খুব অল্প সময়ের জন্য, আমি আপনী কেউ স্থায়ী না, যথা সময়ে আমাকে ফিরে আসতে হলো, বাজুয়া হতে, কিন্তু স্মৃতির পাতায় রয়ে গেল কিছু দৃশ্য যাহা কখনো্ আমার হৃদয় ক্যামেরা থেকে মুছা যাবে বলে আমার মনে হয় না, তাই কিছুটা আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করলাম। এতে যতি পাঠকের সামান্যতম উপকার হয়, বা সামান্য শিক্ষার থাকে তবে আমি অবশ্যই কৃতজ্ঞ্ থাকবো।

Comments

Popular posts from this blog

গোলের রস ও গোলের মিঠা

কাউফল-দেশীয় ফল

"ঢেউয়া" একটি গ্রাম্য অপরিচিত ফল