ফাতরা জংগল ও আমার ছেলেবেলা
কিরে বাদশা ভাল আছ ?
হ্যাঁ মুই ভাল আমি, আমনে ক্যামন আছেন?
হ ভাল।
আচ্ছা বাদশা তোর কি ভয় করে না? একা একা এই মহিষ গুলোকে নিয়া এই ফতরা জংগলে থকতে। বাদশা উত্তর করলো না ভাই জান , মা কইছে। গরিবের ভয় করতে নাই।ভয় ডর থাকে বড় লোকদের।
আচ্ছা, তাই বুঝি। আমি অভাক হলে ওকে একবার দেখলাম। আরে ভয় ডর নাকি গরীবদের থাকতে নাই। এটা আবার কেমন শান্তনা।
একজন মা এমন কঠিক হয় কি করে। যেখানে বাগের ভয় আছে, আছে বিচিত্র ধরনের জীব-জানোয়ার।
আমি আমার বাবা ও চাচার সাথে বাদশাকে দেখার জন্য ফাতরা জংগলে গেলাম । আসলে উদ্যেশ তাকে খাবারের জন্য চাল ডাল লবন ও কিছু বাজার পৌছায়ে দেয়া।
তখন আশ্বিন মাস আমাদের কৃষি কাজের শেষ হয়ে গেলে, মহিষগুলোকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য সাধারনত ফতরা জংগলের চরে পাঠানো হয়। এবং পৌষ মাসের শেষে আনা হয়। কিছু দিন পর পর রাখালদেরকে খাবার পৌছে দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
আমরা যখন সেখানে পৌছলাম বেলা প্রায় শেষ জোয়ারের পানিতে খালগুলো কানায় কানায় পরিপুর্ণ হয়ে আছে। চাচা নৌকাটাকে একটা কেওঢ়া গাছের সাথে বাদলেন এবং আব্বা বারবার মাঝিকে বলতে লাগলেন তাড়া তাড়ি করো, সবাইবে গাছে উঠতে হবে। আর আমাকে ধমকাতে লাগলেন। তোমাকে বললাম আসার প্রয়োজন নাই। তাও আসলে। দেখ কত কষ্ট করতে হয়। একটু সামনে আগাতেই দেখলাম উপরে গাছে আগায় কারা জেন কথা বলে। চাচা বলতে লাগলেন দড়ি নামাও, সাথে দেখলাম কে যেন একটি দড়ি নামিয়ে দলি, চাচা ও মাঝি মাল সামানা দড়ির মাথায় বেধে দিল। দড়ি ও মালামাল গুলো কোথায় গেল বাবাকে প্রশ্ন করতে, তিনি জবাব দিল "আস্তে কথা বলো, কাছা-কাছি মামা থাকতে পারে।" বাবার শাসনে থেমে গেলাম, কিন্ত তার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষন পর দেখলাম একটা ঝুলন্ত সিড়ি আমার কাছে বাবা বললেন তারাতারি করো উপড়ে উঠ। আমি তরতর করে উঠলাম তারপর মাঝি এর পর বাবা, এবং চাচা সবার পেছনে উপরে উঠতে লাগলেন। আমি যখন অনেক উপরে কথন গাছের নিচে মহিস গুলো শুধুই ফোষ ফোষ করতে লাগলো। বাবা ছোট চাচাকে বলতে লাগলেন ভয় নাই নীচে মহিষ গুলো ঝড়ো হয়ে আছে নীচের সিড়িটা তুলে আন। কিছুই বুঝতে পারলাম না। আধা ঘন্টা পড় যখন চাচা ও বাবা গাছের উপড়ে উঠলো তখন দেখতাছি। ছোট চাচা কাফতাছে। আমি চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম "চাচা তোমার কি জ্বর হয়েছে?" চাচা জবাব দিল না। আর একটি উপরে উঠতেই দেখি একটি ঘর ভারী সুন্দরই লাগতাছে। গাছের উপরে ঘর, চারি দিকে অন্ধকার একটি হেরিকেন টিপ টিপ করে জ্বলছে।
চাচাকে বারবার জিজ্ঞাসা করলাম চাচু তোমার কি হয়েছে। চাচু আমাকে বলতেছে রাতে এখানে কোন কথা বলতে নেই। বাবা, চাচা, মাঝি, এবং মহিষের রাখাল চারজন সবাই সবাইর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। এর মধ্যে একজন শক্তি শালী, তার নাম আব্দুল গনি, তিনি বললেন, ভয় নাই, আমাদের কাছে এই লগি ও লেজা আছে, এগুলোকে তারা খুবই ভয় পায়, আর নীচে মহিষ আছে না। ছোট চাচা আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, কিন্ত অনেকটা তো এসে গিয়াছে। এমন সময় আবদুল গনি বললো, আপনারা ভীতরে থাকেন আমি দেখতেছি। একটি লগির মাথায় গামছা বেধে তাতে কেরসিন ঢেলে আগুন লাগাইয়া, নিচের দিকে গুতো মারতাছে, এমন সময় কি একটা পানির মধ্যে লাফাইয়া পইড়া গেল। মহিষ গুলো ডেকে উঠলো। আব্দুল গনি বলতে লাগলো ভয় নাই পালাইছে।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না কিশের ভয় নাই, কেই বা পালাইল। আমাকে গুমাতে একটা কাপড়ের পোটলা দিল মাথার নীচে দেয়ার সাথে সাথে ঘুম এসে গেল। কখন যে সকাল হয়ে গেল কিছুই জানতে পারলাম না
সকাল দশটা বেজে গেছে, গরম ভাত ও সলা-চিংড়ি মাছ রান্না খাইতে বেশ সুন্দর লাগলো এত সুন্দর খাবার ইতি পূর্বে আমি আর কোন দিন খাইছি বলে আমার মনে হয় না। ঘুম থেকে উঠে বাদশাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আরে বাদশা এখানে তুমি এদের সাথে থাকো, সে উত্তর দিল, মাঝে মধ্যে একাও থাকি, তোমার কেমন লাগে।
বাদশা আমাকে পাহাড়া দিতে লাগলো, এবং বলতে লাগলো ঘরের মধ্যে খাকেন, বাইরে আসবেন না। আমি যখন বাহিরে আসতে চাইলাম সে আমার কোমরে একটি দড়ি বেধে দিল, কি ব্যাপার বাদশা তুমি আমাকে বাধতাছ কেন।
বুঝবেন না, পইড়া যাবেন, পইড়া গেলে খাইয়া লাইবে।
মানে, পইড়া যাব, খাইয়া লাইবে।
এই সব তুমি কি কইতাছ, বাদশা?
থুক্কু বুঝবেন না, ভাইজান, সবাই নিচে গেছে, এখনই আসবো।
ঘন্টা খানেক পড়ে দেখি গাছের ঘোড়ায় সবগুলো মহিষ এবং বাবা, চাচা, মাঝি, এবং মহিষের তিন জন রাখাল সবাই আসলো,
খানা শেষ করলাম ।
বাবা বলতে লাগলেন, সময় থাকতে জংগলের এরিয়া পাড় হতে হবে।
সবাই তারাতারি খাবার শেষ করলাম। কিছু মাছের তরকারী একটা পাতিলে করে মাঝি আটসাট করে বেধে নিল আমরা চার জন দড়ির সিড়ি বেয়ে নিচে নামলাম এবং একদম নেীকায়, কিসের এত ভয় কেন এত ভয় কিছুই বুঝতে পারলাম না। মাঝি তারাতারি নৌকা ছাড়লো, চাচা দাড় টানতে লাগলেন এবং গাজি-কালু বলতে লাগলেন। বাবা সমনে একটি লগি নিয়া দাড়াইয়া আছে কিছুই বুঝতে পারলাম না।
নদীতে ঝপাত করে একটি শব্দ, আর মাঝির চিৎকার, দোহাই শাহ গাজি-কালু. কিছুই বুঝে উঠার আগে, বাবা বলে উঠলেন ভয় নাই আমি সমনে আছি। তারে আমি জানে মাইরা হালাইমু, এদিকে আইস না। দোহাই গাজি-কালু, আমার কাছে মনে হলো বড় ধরনের একটি বিড়াল, আমি নৌকার মাঝে চুপটি মেরে আছি। মাঝির চোখ দিয়া পানি আইসা গেল। বিড়াল টা আবার সাতরাইয়া জংগলের মধ্যে গেল।
কিছু সময় পর আমরা পায়রা নদীতে এসে পড়লাম অনেক বড় বড় তুফান তার মাঝে বাবা বলতে লাগলেন, ভয় নাই জোয়ার এসে যাবে এবং তুফান কুমে যাবে। তাই হলো, তুফান আস্তে আস্তে কুমতে লাগলো। তরতর করে নৌকা উত্তর দিকে ছুটতেছে। ছোট চাচা নৌকার হাল ধরলে আর মাঝি ভাত রান্ন করতে লাগলেন।
আমরা নদীর বাকে এসে নৌকা বাধবো, কারন জোয়ার শেষ হয়ে গেছে । আবার জোয়ার না আসা পযন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। এই সমস্ত নদীতে ভাটা জোয়ার না আসা পর্যন্ত নৌকা চালানোর কোন পথ নাই। মাঝি বেতি চিকন চালের ভাত রান্না করলো এবং সলা-চিংড়ি মাছের তরকারী, চাচা বলতে লাগলেন, মাজাভাই, ইলশা মাছ কিনো, হ্যাঁ ইতিমধ্যে জেলেরা জাল তুলে কিনারে আসতে লাগলো, আমাদেরকে দেখে তারা অভাব নয়নে তাকাইতে লাগলো, কারন টা অনেক পরে বুঝতে পাড়লাম বটে।
জেলেরা বলা বলি করতে লাগলেন কোথায় আইছেন, বাড়ী কোথায়, কেন বা আসছেন, হাজারও প্রশ্নের জবাব দেওয়া আরকি এর মধ্যে একজন বুড় মানুষ তিনি বাবাকে বলতে লাগলেন "মাষ্টার সাব, রাখালদের খাবার দিতে আইছেন," বাবা বললেন, "জি" সবাই থেমে গেল। মাঝি ইলিশ মাছের কথা বললে, বুড় লোক টা দুইটা মাছ উঠাইয়া আমাদের নৌকায় তুইলা দিল। তবে এতবড় ইলিশ মাছ আমি ইতি পুর্বে আর দেখি নাই। বাবা দাম জানতে চাইল তিনি উত্তর দিলেন , বাজারে বড়জোড় এর দাম হবে একটাকা। মাষ্টার সাব দামের প্রয়োজন, কারন আপনারা আমাদের মেহমান।
নৌকাগুলো নদীর কিনারে ভিরলো না একটু মাঝে নোংঙর ফেললো এবং আমাদের নৌকা তাদের সাথে বাধতে বললেন। আমাদের সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, এর কারন বুঝতে পারলাম না, মাঝিরা বলাবলি করতে লাগলেন জোয়ার উঠলে আপনারা নৌকা ছাড়বেন আমরাও জাল ফেলতে যাবো।
অনেক দেড়িতে হলেও বুঝতে পাড়লাম, নৌকা কেন কিনারে না বেধে জেলেদের নৌকার সাখে বাধলো। সেই একই মামার গল্প, কিনারে মামা আছে। তবে, আমি বুঝতে পারলাম আমার মামা আমাকে বেশ আদর করে, কিন্ত এই মামাকে সবাই ভয় পায় কেন, এ আবার কেমন মামা। রাতে একটা ডাক শুনলাম ঘুম ভেংগে গেল, জেলেরা , বলতে শুনলাম, দোহাই বাবা গাজি-কালু। মাঝিরা সবাই হাতে বড় বড় লগি বৈঠা নিলো, কেউ বা হাতে মশাল ঝালাইয়া নিল, কিন্ত মশালকে তারা নাকি বেশী ভয় পায়।
বুড়ো মাঝি বলতে লাগলেন যে, সিরনি রানতে হবে, এবং নদীতে ভাষাই দিতে হবে। না হয় তারা ফিরবে না। কয়েক দিন আগে নাকি তাদের একজনকে নিয়ে গেছে, তাকে আর পাওয়া যায় নাই।
আমি বাবাকে ও চাচাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে লাগলাম, দেখ দেখ দুইটা গাছ ভাইসা যাইতেছে, বাবা বললেন নৌকার ভীতরে আসো, চাচা মাঝিকে সাবধান করে বলতে লাগলেন নৌকার ভীতরে আস, ওটা কিন্তু ডুব দিয়াছে। কিছুক্ষন পরে দেখলাম একটা কুমির নৌকার কাছে অনেক খানি মাথা তুলেছে এবং হা করে মাথা নোয়াই দিল, জংগলে আমি ভয় পাইনি তবে এবার ভয় পাইলাম যে এটা একটা কুমির,
কুমির টা যেই ভাবে নৌকায় গুতো দিয়াছে তাতে আমাদের পাতিলের ঢাকনা নদীতে পড়ে গেল। ভয় ও বিপদ প্রতিটি পদে পদে, এযেন এক কঠিন সময় পার করলাম। বাবা আমাকে একটা গামলায় করে ভাত খেতে দিলেন, ইলিম ও চিংড়ি মাছের তরকারী দিয়ে খুবই সাধের তরকারী। পেট ভরে ভাত খেলাম এত খাবার আর আমি কখনও খাইনি। বাবা, চাচা ও মাঝি নৌকার চালাইতে লাগলেন। কঠিন অন্ধোকার কিছুই দেখা যায় না
বানর ও সিয়ালের ডাক ছাড়া আর কিছুই নাই। আমি ঘুমিয়ে গেলাম, সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি তালতলি বাজার, ঘাটে নৌকা বাধা। বাবা ও চাচা বাজারে গিয়াছে এবং মাঝি গোসল করতাছে।
মাঝিকে জানতে চাইলাম যে, কালকে যে একটা বড় বিড়াল দেখলাম, তুমি ভয় পেয়েছ, তিনি আমাকে দমক দিয়া বললেন, "ওটা বিড়াল বা বাঘ, পদে পদে বিপদ, আর আসবো না"
Comments
Post a Comment